ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সরিষা ইউনিয়ের খানপুর গ্রামের ২৫ বছর বয়সী তরুণ মো. মাহফুজ। কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে চলতি বছর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন। পড়াশোনা করে সফল কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর। ইউটিউব দেখে এবং কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে কমলা চাষ শুরুও করেন। ২০২০ সালে ২০ শতাংশ জমিতে কমলা আবাদ শুরু করেন।
বর্তমানে তাঁর ৪০ শতাংশের বাগানে ১১৩ টি কমলা গাছের চারা রয়েছে। বাগানের শতাধিক গাছের থোকায় থোকায় কমলা ধরেছে। কমলা আকারে যেমন বড়, তেমন স্বাদেও খুব মিষ্টি। মাহফুজ আরও জানান, প্রতিটি গাছে ৪০ থেকে ১শতাধিক করে কমলা ধরেছে।এভাবে চাষাবাদ করে ছাত্রজীবনেই সফল তিনি। তাঁকে দেখে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন মানুষ।
মাহফুজ উপজেলার সরিষা ইউনিয়ের খানপুর গ্রামের আব্দুল হেলিমের ছেলে। বাড়ির পাশেই লংগাইল গ্রামের নিজেদের ৪০ শতাংশ জমিতে তিনি ওই কমলাবাগানটি করেছেন। এই বাগান দেখতে প্রতিদিন ভিড় করছেন বিভিন্ন এলাকার ফলচাষিরা। বাগানের মাচা তৈরি করে রাতে সেখানেই ঘুমান তিনি। তাঁর ভাষ্য, চাকরিতে আয় সীমিত। আধুনিক চাষাবাদ লাভজনক। সে জন্য পড়াশোনা করে চাকরির জন্য বসে না থেকে চাষাবাদ শুরু করেন। নিজের জমানো কিছু টাকা ও ধারদেনা করে ১০০টি কমলার চারা রাজশাহী থেকে কিনে এনেছিলেন। তখন সবমিলিয়ে খরচ হয়েছিল প্রায় ২৫ হাজার টাকা। কমলা চাষে সফল হতে পারবেন না বলে শুরুতে পরিবার ও এলাকাবাসীর অনেক কথাও শুনতে হয়েছে তাকে। কিন্তু হাল ছাড়েনি মাহফুজ। চারা রোপণের ৩ বছরে তেমন সাফল্য না পেলেও চতুর্থ বছরে কমলাবাগানে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন তিনি।
জানা গেছে, ২০১৫ সালে উপজেলার সোহাগি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন মাহফুজ। পারিবারিক কারণে তিনি একবছর লেখাপড়া করেননি। ২০১৭ সালে ঈশ্বরগঞ্জ আইডিয়াল কলেজের একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখান থেকে ২০১৮ সালে এইচএসসি পাস করেন। এইচএসসি পাসের পরে চাকুরির পিছনে না দৌড়ে নিজে কিছু করে স্বাবলম্বী হওয়ার পরিকল্পনা করেন মাহফুজ। সে অনুযায়ী ইউটিউব ও অনলাইনে কমলা চাষ করে দেশের অনেক যুবককে স্বাবলম্বী হওয়ার ভিডিও দেখে নিজেও কমলাবাগান করতে উদ্বুদ্ধ হন। অতঃপর ২০২০ সালে ১০০টি কমলার চারা দিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করেন। কমলা চাষের পাশাপাশি বর্তমানে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে চলতি বছর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন।
সরেজমিনে বাগানে গিয়ে দেখা যায়, গাছগুলোয় কমলা ধরে আছে। কোনোটা পেকে হলুদ হয়ে গেছে। আবার কোনোটা সবুজ রয়ে গেছে। মাহফুজ পরিচর্যা করছেন বাগান। এসময় তিনি বলেন,' গতবছর ২০ হাজার টাকার মতো কমলা বিক্রি করেছিলাম। এবছর ৬০ থেকে ৭০ মণের বেশি কমলা বিক্রির আশা করছি। বাগান ও বাজার থেকে কমলার দরের তারতম্য অনুযায়ী ১৫০ থেকে ২৫০ টাকায় প্রতি কেজি কমলা বিক্রি হচ্ছে। আশা করছি ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার মতো কমলা বিক্রি করতে পারবো। বাগানটিতে
শুরু থেকে এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় ৩ লাখ টাকা। বর্তমানে যে পরিমাণ ফলন হয়েছে তাতে খরচ উঠেও ২ থেকে ৩ লাখ টাকা লাভ হবে বলে আশা করছি। অনেক আত্মীয়স্বজন, এলাকাবাসী এবং দুরদূরান্ত থেকে দেখতে আসা মানুষ তাকে দেখে কমলা চাষে উৎসাহী হচ্ছেন। ইতোমধ্যে বাগান থেকেই দেড়'শ টাকা কেজি দরে ও স্থানীয় আঠারবাড়ি বাজারে খুচরা ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে প্রায় লাখ টাকার কমলা বিক্রি করছেন মাহফুজ।
বেকার যুবকদের উদ্দেশ্যে মাহফুজ বলেন, 'যারা লেখাপড়া করে চাকুরির পিছনে দৌড়েও কোন চাকুরী পাচ্ছে না, তারা কমলা চাষ কিংবা অন্য কোন ফল চাষ করে নিজে উদ্যোক্তা হয়ে অন্যদের কর্মসংস্থান তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
স্থানীয় রাসেল মিয়া(২৭) তিনি বলেন, এর আগে আমাদের এলাকায় কেউ কমলার বাগান করে সফল হতে পারেননি। মাহফুজ ইউটিউব ও অনলাইনে ভিডিও দেখে কমলার চাষ শুরু করে।প্রথমবার ফলন কম হয়। এবার ভালো ফলন হয়েছে। সামনে ফলন আরও বাড়বে।
মাহফুজের কমলার চাষের সাফল্য দেখে তাঁর নিজ এলাকা তো বটেই, আশপাশের বিভিন্ন এলাকার লোকজন কমলা চাষে উৎসাহী হচ্ছেন। মাহফুজের বাগানেই কথা হয় লংগাইল গ্রামের জুনাঈদ হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, মাহফুজের বাগানের কমলা ভালো ফলন দেখে তিনি নিজেও কমলা চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রিপা রানী চৌহান বলেন, ঈশ্বরগঞ্জের মাটি ও আবহাওয়া কমলা চাষের জন্য মোটামুটি উপযোগী। অনেক পরিশ্রম করে মাহফুজ কমলাবাগানে সফলতা পেয়েছেন। আশা করছি তিনি লাভবান হবেন। যাঁরা বেকার রয়েছেন, তাঁরা মাহফুজের কমলার বাগান দেখে উদ্বুদ্ধ হবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে মাঠপর্যায়ের কর্মীরা মাহফুজকে সময়ে সময়ে পরামর্শও দিচ্ছেন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেউ যদি এধরনের কমলা, মালটা বা যে কোন লেবু জাতীয় ফল চাষে আগ্রহী হয় তাহলে কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা ও পরামর্শ প্রদান করা হবে।